দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইমামদের বয়ান দেওয়ার অনুরোধ বিচারপতির 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে ইমামদের বয়ান দেওয়ার অনুরোধ বিচারপতির 

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেছেন,ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের অনুরোধ করব যেন প্রতিটি সরকারি মসজিদে এবং যেসব মসজিদে সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, বিচারপতি বা বিচারকরা নামাজ পড়েন সেসব মসজিদের খতিবদের কাছে সার্কুলার পাঠান যেন বয়ানের সময় তারা দুর্নীতি সম্পর্কে বক্তব্য দেন। প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ সুপ্রিম কোর্টে নিয়ন্ত্রণাধীন যত মসজিদ আছে, অধস্তন আদালতে জেলা জজদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মসজিদের ইমাম ও খতিবদের কাছে সার্কুলার পাঠানো হোক যাতে অন্যান্য বয়ানের সঙ্গে দুর্নীতি নিয়ে বয়ান করা হয়।

শনিবার সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনে ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন সাংবাদিকতা’ শীর্ষক কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিচারপতি হাসান আরিফ এসব কথা বলেন।  আইন, বিচার ও মানবাধিকার বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) এ কর্মশালার আয়োজন করে।

বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেন, শুধু অর্থের দুর্নীতিই দুর্নীতি নয়, মামলায় রায় দিয়ে কোনো পক্ষের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়াও দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। দুর্নীতি নিয়ে যখন কথা বলবেন তখন শুধু টাকার দুর্নীতিই নয়, সুবিধা নেওয়ারও দুর্নীতিও সামনে তুলে ধরতে হবে।

বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, শুধু অর্থের দুর্নীতিই দুর্নীতি নয়, অর্থ ছাড়াও অনেক রকমের দুর্নীতি রয়েছে। দুর্নীতি নিয়ে আমাদের পুরো দৃষ্টিভঙ্গি থাকে টাকা নিয়ে রায় দিয়েছে কি না, মামলার কার্যতালিকার উপরের দিকে এসেছে কি না। এর বাইরেও যে কত রকমের দুর্নীতি আছে সেটা জানতে হবে। দণ্ডবিধির ১৬১ ধারায় উদাহরণটা দিয়েছে এরকম যে, একজন মুন্সেফ একজন ব্যাংকারকে বলছে তোমার কাজটি (আমার কাছে যে মামলা আছে) আমি করে দেব, তবে তুমি আমার ছোট ভাইকে তোমার ব্যাংকে একটা চাকরি দিও। এখানে টাকার কোনো লেনদেন নেই। মুন্সেফ তার ভাইয়ের জন্য একটা বেনিফিট নিচ্ছেন এভাবে। অর্থাৎ ভাইকে চাকরি পাইয়ে দিয়ে তার বিনিময়ে একটা নির্দিষ্ট পথে চাকরিদাতাকে রায় দিয়ে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, মনে করেন আমার বেঞ্চে একটা পলিটিকাল কনট্রোভার্সিয়াল মামলা আসল আমি জানি এই মামলায় যদি এই পক্ষে রায় দিই খুব তাড়াতাড়ি আমি আপিল বিভাগে যেতে পারব। আবার যদি এভাবে রায় দিই কখনোই আপিল বিভাগে যেতে পারব না। তাহলে মামলায় এভাবে রায় দিলে আমি যাতে আপিল বিভাগে যেতে পারি- টিআইবির সংজ্ঞা এবং দণ্ডবিধির ১৬১ ধারা অনুযায়ী এটা দুর্নীতি। কিন্তু আমরা যখন বিচারকদের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলি এই বিষয়টা আমাদের মাথায় থাকে না। মনে করেন একজন সেশন জাজ তার কাছে একটা বড় মামলা আসল যেখানে সরকার পক্ষ চায় রায়টা এ রকম হওয়া উচিত এবং বিচারক সেরকম রায় দিলেন, কিছুদিন পর ওই বিচারক হাইকোর্টের বিচারপতি হয়ে গেলেন এটাও তো দুর্নীতি। বিচারকদের দুর্নীতি নিয়ে লিখুন, তবে সেই লেখনী সত্য হতে হবে। লেখনী মিথ্যা হলে একজন বিচারকের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ধ্বংস হয়ে যায়।

তিনি বলেন, আমাদের (বিচারক) স্পষ্ট আচরণবিধিমালা আছে। কিন্তু এর কোন প্রয়োগ নেই। সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. লতিফুর রহমান আচরণ বিধিমালা করেছিলেন। কোথাও যেতে বা তদবির করতে পারব কি পারব না। এগুলো অনেকেই কেয়ার’স (মেনে) করেন। কিন্তু একটা ভালো অংশই আছে যারা এটা মেনেই চলেন না। তারা হরদম তদবিরবাজিতে থাকেন, হরদম ক্ষমতার অপব্যবহার করে তদবিরবাজি করেন। সংবিধান ও আইন আমার উপর একটা ক্ষমতা অর্পণ করেছে আমি সেই ক্ষমতাকে অপব্যবহার করছি আমার বেনিফিটের জন্য, আমার আত্মীয়-স্বজনদের বেনিফিটের জন্য, এটাই হলো দুর্নীতি। 

বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, একজন জজের কাজ কি তদবির করা! অমুকের চাকরি নেই, তাকে চাকরি দেন, পদোন্নতি পাচ্ছে না তাকে পদোন্নতি দিয়ে দেন। এর বিনিময়ে ওই লোককে কোন মামলায় সুবিধা পাইয়ে দেওয়াটাও বড় ধরনের দুর্নীতি। এ ধরনের দুর্নীতি অপ্রকাশিতই থেকে যায়।

বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, আমাদের জাজদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, সুপ্রিম কোর্টের কোথাও একটা পিন পড়লে প্রধান বিচারপতি জানেন। তাহলে সুপ্রিম কোর্টের সব খবর প্রত্যেক প্রধান বিচারপতির কাছে ছিল। তাহলে দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকের বিরুদ্ধে শাস্তি দেওয়ার জন্য হাতেনাতে ধরার প্রমাণের অপেক্ষায় কেন থাকতে হবে। যে বিচারকের নামে ভবনের ইট, বালু, ধুলা-বালি এমনকি সুপ্রিম কোর্টের সবাই বলে করাপ্ট (দুর্নীতিগ্রস্ত) সেই বিচারককে কেন গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চগুলোতে বসিয়ে দেওয়া হবে। অতীতে প্রধান বিচারপতিরা এ ধরনের বিচারকদের গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চের দায়িত্ব দিয়েছেন। একদিন হাতেনাতে ধরা পড়বে, সিনিয়র আইনজীবীরা ওপেন কোর্টে চিৎকার করবে ওই বিচারক দুর্নীতিবাজ, তখন সেই জাজের বিরুদ্ধে কোন একটা অ্যাকশনে যাবে, সেটা কেন হবে।

তিনি বলেন, বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী মামলা রিভিউ হওয়ায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নিয়ে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থায় আছি আমরা। মামলাটা সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ের পর একটি কোড অব কন্ডাক্ট (আচরণ বিধিমালা) জাজদের দেওয়া হয়েছিল। এই আচরণ বিধিমালাটা আছে কি না আমি কনফিউজড। এই মামলাটি বিচারাধীন থাকায় বিচারকদের জবাবদিহিতাও ঝুলন্ত অবস্থায় আছে। একজন বিচারককে জবাবদিহিতার আওতায় আনার বিষয়টি অর্থাৎ সেটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল হোক বা সংসদের মাধ্যমে হোক তা আট বছর ধরে ঝুলছে। তাহলে কি বার্তা দিচ্ছি আমরা সেইসব বিচারকদের যাদের সম্পর্কে ইট, বালু, পাথর সবাই জানে তারা সৎ নন। একজন বিচারক যদি দুর্নীতির অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হন তাহলে তার বিরুদ্ধে কোন পদ্ধতিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এমন পদ্ধতি এখন বিদ্যমান আছে কি? 

বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, দুর্নীতির সংজ্ঞা নিয়ে আমাদের প্রচুর কনফিউশন (দ্বিধা) কাজ করে। দুদক আইনে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা হলো তফসিলে বর্ণিত অপরাধসমূহ হলো দুর্নীতি। অর্থাৎ দুর্নীতি সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে এই আইনের তফসিলে যেতে হবে। এই আইন পড়ে সাধারণ মানুষের পক্ষে দুর্নীতির সংজ্ঞা বোঝাটা খুবই কঠিন। দুর্নীতি বলতে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনকেই বুঝিয়েছে। আমি মনে করি এটা খুবই জটিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আইনের এই জায়গাটাতে (দুর্নীতির সংজ্ঞায়) সংশোধনী আনা উচিত। আইনে একটা সহজলভ্য সংজ্ঞা দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটা সংজ্ঞা দিয়েছে, যা খুবই সহজ। টিআইবি বলছে, আইনে যে ক্ষমতাটা দেওয়া হয়েছে সেটা নিজের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য করলে তাই হলো দুর্নীতি।

তিনি বলেন, আমরা এমন এমন ইস্যুতে জনস্বার্থমূলক মামলা নিয়েছি বা করেছি তা হাস্যকর। কল্পনাও করা যায় না এগুলো এখনো কোর্টে বিচারাধীন আছে। এগুলো নিয়ে আইনজীবীরা আমার কোর্টে আসে মাঝে মধ্যে শুনানি করার জন্য। আমি বলেছি অন্য কোর্টে যান, আমি আপাতত এ ধরনের মামলা শুনছি না। ২/১ টা মাঝে মাঝে করি না তা নয়। এত এত হাস্যকর জনস্বার্থ মামলা আছে কল্পনা করতে পারবেন না।

বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, রিপোর্টার ও সাংবাদিকের মধ্যে অনেক তফাত আছে। সাংবাদিকতা এবং রিপোর্ট করা এক বিষয় নয়। রিপোর্ট হলো এখানে একটা ঘটনা ঘটেছে সেটা তুলে ধরা। আর সাংবাদিকতা হলো আমি শুধু রিপোর্ট করছি না এর পেছনে-বাইরে আদ্যোপান্ত  যা যা আছে সব তুলে ধরা। সেখানে নিজস্ব মতামতও তুলে ধর। এটা সঠিকও হতে পারে, আবার পাবলিক সেটাকে গ্রহণ নাও করতে পারে। মিজানুর রহমান খান ছিলেন একজন লিজেন্ড্রারি জার্নালিস্ট। তিনি আমাকে অপমান করে পত্রিকায় লিখেছেন, কিন্তু আমি কখনোই তা ব্যক্তিগতভাবে নেইনি। যখনই দেখা হয়েছে হেসে কথা বলেছি। ব্যক্তিগতভাবে কেন নেইনি, কারণ উনি উনার দায়িত্ব পালন করেছেন। জজ হওয়ার আগেও যেমন সম্পর্ক ছিল, জজ হওয়ার পরেও সেরকম সম্পর্ক ছিল তার সাথে। যদিও জজ হওয়ার পরেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকার কারণে উনি বিন্দুমাত্র দয়া না দেখিয়ে আমাকে নিয়ে রিপোর্ট করেছেন, এটাই সাংবাদিকতা।

বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, হাইকোর্ট বিভাগে জুরিসপ্রুডেন্স ডেভেলপমেন্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর সীমাবদ্ধতা আছে। ১০ বিচারকের মামলায় বিচারপতি আব্দুর রশিদ যে রায় দিয়েছিলেন সেটা একটা চমৎকার জুরিসপ্রুডেন্স ডেভেলপ করেছিল। এটা এখন নেই। আমাদের জুরিসপ্রুডেন্সের বর্তমান যে অবস্থা এক হাত আছে তো আরেক হাত নেই। 

বিচারপতি হাসান আরিফ বলেন, দুর্নীতি না করার বিষয়ে সরকারি মসজিদগুলোর খতিব বা ইমামরা বয়ানের সময়ে কখনো কিছু বলেন না। তাদের এ বিষয়ে বয়ান করা উচিত। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা আছেন, তাদেরকে অনুরোধ করব যেন প্রতিটি সরকারি মসজিদে এবং যেসব মসজিদে সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, বিচারপতি বা বিচারকরা নামাজ পড়েন সেসব মসজিদের খতিবদের কাছে সার্কুলার পাঠান যেন বয়ানের সময় তারা দুর্নীতি সম্পর্কে বক্তব্য দেন। প্রধান বিচারপতির কাছে অনুরোধ সুপ্রিম কোর্টে নিয়ন্ত্রণাধীন যত মসজিদ আছে, অধস্তন আদালতে জেলা জজদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মসজিদের ইমাম ও খতিবদের কাছে সার্কুলার পাঠানো হোক যাতে অন্যান্য বয়ানের সাথে দুর্নীতি নিয়ে বয়ান করা হয়।

কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন এলআরএফ সভাপতি মাসউদুর রহমান রানা। সঞ্চালনায় ছিলেন সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো. খুরশীদদ আলম খান ও চ্যানেল আইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি মাজহারুল হক মান্না। পরে অংশগ্রহণকারীদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দেন প্রধান অতিথি।

খুরশীদ আলম খান বলেন, হুন্ডির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে প্রবাসীর স্বজনরা দেশে দ্রুত ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পান। সেটা না করে হুন্ডির বিরুদ্ধে লড়ার সুযোগ নেই। কারণ হুন্ডির মাধ্যমে স্বজনরা এক ঘণ্টার মধ্যে দেশে বসে টাকা পেয়ে যাচ্ছে। সেখানে ব্যাংকিং চ্যানেলে লাগছে অনেক সময়। এ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি পদ্ধতি বের করতে হবে। বিএফআইইউকে হুন্ডি প্রতিরোধে লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে। 

এমএইচডি/এসকেডি

Visit Source Page

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *