বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদ হত্যার বিচার চেয়েছে তার পরিবার। গঠিত হতে যাওয়া নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এ দাবি জানানো হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদ হত্যার বিচার চেয়েছে তার পরিবার। গঠিত হতে যাওয়া নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এ দাবি জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি এ দাবি জানান।
আবু হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের ছাত্র-জনতা ন্যায্য দাবিতে রাজপথে নেমেছিল। তাদের নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছে। আমি এসব হত্যাকাণ্ডের ন্যায্য বিচার চাই। আমার ভাইকে যেন রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তাঘাট যেন হয়। সে যেন দেশের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকতে পারে। আর ভবিষ্যতে যে সরকার আসবে, তারা যেন জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি সম্মান দেখায়। আর যেন গুলিতে কারও প্রাণ না নেয়।
আরেক বড় ভাই রমজান আলীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার শহীদ ভাই দেশে ছাত্র-জনতার মাঝে কোটা আন্দোলনের সূচনা করে গেছেন। পরে সেটি সরকার পতনের দিকে চলে যায়। শেষ পর্যন্ত সরকারের পতন হয়েছে। আজ আবু সাঈদ আমাদের মাঝে নেই। সেই বেদনা ভুলতে পারিনি। নতুন সরকার যিনি আসছেন উনি যেন দেশে আর মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ না করেন।
তিনি আরও বলেন, এখন সরকারের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক। শুধু আমার ভাই নয় যতগুলো মানুষের প্রাণ গেছে তারাও যেন বিচার পায়। আমি চাই, আমার ভাইকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হোক। রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজের নামকরণের মাধ্যমে তাকে স্মরণীয় করে রাখা হোক। তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে যেন নতুন প্রজন্ম নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।
আবু সাঈদের চাচাতো ভাই ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষমতা, অহংকার, দাম্ভিকতা, অর্থসম্পদ কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। সেটা এখন ভুলে গেলে হবে না। আল্লাহ সম্মান দেন আবার কেড়েও নেন। যদি না কেউ সেই সম্মান-মর্যাদা ধরে রাখতে না পারে। কত নিরীহ, নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। আজ কিন্তু তাদের পতন হয়েছে। আমার ভাই সেই স্বৈরাচারী সরকারের পতনের আন্দোলনে বুক পেতে দিয়ে শহীদ হয়েছেন। তার আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয়কে সত্যিকারের সমতাভিত্তিক বৈষম্যহীন নিরাপদ সমাজ গঠনে কাজে লাগাতে হবে। নয়ত শত শত শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে আবু সাঈদ। নয় ভাই-বোনের মধ্যে আবু সাঈদ ছিল সবচেয়ে ছোট। ভাই-বোনদের মধ্যে আবু সাঈদ ছাড়া কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখেনি। লেখাপড়া বেশি না করায় অন্যরা কৃষিকাজসহ দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মেধাবী আবু সাঈদ অষ্টম শ্রেণি, এসএসসি, এইচএসসিতে ভালো ফল অর্জন করে এবং বৃত্তি পায়। আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২তম ব্যাচের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার পরিবারের আশা ছিল বিসিএস ক্যাডার হয়ে আবু সাঈদ পরিবারের হাল ধরবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে গত ১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে পুলিশ-ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। পরদিন ১৭ জুলাই তাকে পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ।
তার মৃত্যুর ঘটনায় ১৭ জুলাই মেট্রোপলিটন তাজহাট থানায় মামলা করা হয়। মামলার বাদী ওই থানার উপপরিদর্শক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায়।
মামলার সংক্ষিপ্ত এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ‘বেলা ২টা ১৫ মিনিটের দিকে ছাত্র নামধারী সুবিধাভোগী রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনরত দুর্বৃত্তগণ বিভিন্ন দিক থেকে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও তাদের নিকটে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র হতে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশও এপিসি গাড়ির মধ্য হতে কং/ ১১৮৬ সোহেল তার নামীয় সরকারি ইস্যুকৃত শটগান হইতে ১৬৯ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।’
সাঈদের মৃত্যুর বিষয়ে বলা হয়, ‘বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের এক পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সহপাঠীরা ধরাধরি করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ২ থেকে ৩ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।’
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ